বেসরকারিভাবে টিকাদান কর্মসূচি চালু হলে খুবই ফলপ্রসূ হবে
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য। বর্তমানে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত করোনা সম্পর্কিত কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশে করোনার ভয়াবহ বিস্তার ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রস্তাবিত লকডাউন এবং মহামারী প্রতিরোধের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : দেশে করোনা শনাক্তের এক বছর পার হলো চলতি বছরের মার্চ মাসে। ফেব্রুয়ারি থেকেই প্রতিদিন শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এই সময়ে করোনার গতি-প্রকৃতি ও ব্যাপক বিস্তার রোধ কেন সম্ভব হলো না বলে মনে করছেন? করোনা কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল এত দ্রুত?
মোহাম্মদ সহিদুল্লা : গত বছরের ৮ মার্চে দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার পরে আমরা দেখলাম যে, করোনা খুবই ধীরগতিতে ছড়াচ্ছে। মধ্য মে থেকে জুনের দিকে সেটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ল। তবে তখন সেটিকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল। তখন মৃত্যুর হারও তুলনামূলক কম ছিল। কিন্তু চলতি বছরের মার্চে এসে দেখা গেল করোনা আমাদের আশঙ্কা থেকেও দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এক মাসের মধ্যেই আমরা দেখছি করোনার মৃত্যু এবং শনাক্ত দুটোই ভয়াবহ পর্যায়ে বাড়ছে। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখব যে, স্প্যানিশ ফ্লু যখন হয়েছিল, সেটিরও সেকেন্ড ওয়েভ খুবই তীব্র ছিল। আমরা যে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছি, তার জন্য ভ্যাকসিন দিচ্ছি, কিন্তু সেটিও পৃথিবীর মানুষের তুলনায় দুই তিন শতাংশের বেশি হবে না। তাই শেষ পর্যন্ত লড়াইটা অসম হচ্ছে এখনো। এবার যখন দেশে করোনার প্রকোপ ভয়াবহ হলো, তখন ভাইরোলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছিলেন, এবারের ভাইরাসে গতবারের চেয়ে ভিন্নতা রয়েছে। পরে আইসিডিডিআর ছাড়াও বেশ কয়েকটি ল্যাবরেটরি টেস্টের রিপোর্টে জানা গেল করোনার এই তীব্রতার জন্য সাউথ আফ্রিকান ভাইরাসই দায়ী। করোনা রোগী শনাক্তের প্রায় ৮১ ভাগের নমুনায় সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়া ইউকে ভ্যারিয়েন্টও রয়েছে। আর এই ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতাও অনেক বেশি। তবে কেবল এই একটি কারণেই যে দেশে সংক্রমণ বেড়ে গেল, এমনটাও নয়। আমরা কেউ তো সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলিনি। গেল বারে যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছে, এইবারে দেখা গেল তারা শিথিলতা দেখিয়েছে। আবার একটি গ্রুপ কখনোই নিয়ম মেনে চলেনি। এইবার দেখা গেল করোনাকালীন সাধারণ ছুটি উঠে গেলে সবাই ঘুরে বেড়িয়েছে। কক্সবাজার, বান্দরবানসহ দেশের পর্যটন এলাকাগুলোতে প্রচুর সংখ্যক লোক বেড়াতে গেল। সবার মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে এক ধরনের শৈথিল্য দেখা দেয়। এখন স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সেবার পরিধি বাড়ানোর বিকল্প নেই। এই সুযোগেই করোনা আক্রমণ করেছে। মোটা দাগে, দুটি কারণে এইবারের সংক্রমণ অধিক হচ্ছে করোনার সাউথ আফ্রিকান ও ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানা।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির একটি সভা হয়েছে ৭ এপ্রিল। আপনার সভাপতিত্বে সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুই সপ্তাহের লকডাউনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের করোনা মহামারী সংক্রমণের পরেও লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে সরকার তখন সাধারণ ছুটি বলেছিল। এ বছর দেখা গেল প্রথমে এক সপ্তাহের জন্য ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ এলো। ১৮টি নির্দেশনা পাওয়া গেল। সেটি কার্যত পালিত হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে দুই সপ্তাহের লকডাউন কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে?
মোহাম্মদ সহিদুল্লা : যে ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সেটি খুবই কার্যকর হতো, যদি তা যথাযথ পালন করা যেত। এরপরে সরকার ১১ দফা নির্দেশনাও দিয়েছিল। সেটিও পালন করা হয়নি। গণপরিবহনসহ অফিস ব্যবস্থাপনা ও কর্মঘণ্টা বিষয়ে নির্দেশনাও আমলে নেওয়া হলো না। মহামারী চলাকালে ‘আমি মানব না, বাকিরা নিয়ম মানুক’ এমন দাবি খুবই ক্ষতিকর এবং আত্মঘাতী। নিয়ম সবার সমানভাবে মানতে হবে। গণপরিবহন বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অফিসগামী লোকজন বিক্ষোভ করল, সরকার দাবি মেনে নিল। সবাই বাসে ভিড় করল। আবার ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করল তাদের দোকানপাট খোলার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হলো। এইভাবে সব জায়গাতেই করোনার স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হতে থাকল। এখন আমাদের ধারণা, করোনার এই ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পাবে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু উভয় সংখ্যাই আরও বাড়বে। এখন গত কয়েকদিন ধরে শনাক্ত ৭ হাজারের ওপরে রয়েছে। মৃত্যু ৬০-এর ঘরে। এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছি। এই পরিস্থিতিতে আমরা কঠোর লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছি। আমাদের পরামর্শক কমিটি যেমন জীবন বাঁচাতে লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছে, তেমনি জীবিকার ব্যবস্থাও ভাবতে হচ্ছে। আমাদের ব্যবসায়ীরা ঈদকে সামনে রেখে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেছে। তাই সবদিক বিবেচনা করে এখন এই সময় থেকে যদি দুই সপ্তাহ সর্বাত্মক লকডাউন পালন করা যায়, তবে সেটি সবার জন্যই মঙ্গল হবে। লকডাউন মানে এই দুই সপ্তাহ কেউ ঘর থেকে বের হবে না। এতে করে সংক্রমণের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে। ঈদের বাকি রয়েছে এখনো প্রায় ৫ সপ্তাহ। সাধারণত ঈদের বেচাবিক্রি ঈদের আগের এক বা দুই সপ্তাহ হয়ে থাকে। এখন নিয়ম মানলে সেই সময়ে সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়ার একটি পরিস্থিতি হয়তো তৈরি হবে। এখন দরকার একটি কঠোর লকডাউন। সরকার এখন হয়তো এক সপ্তাহের কথা বলছে, তবে আমার ধারণা পরে এটিকেই দুই সপ্তাহ করা হতে পারে।
করোনা নিয়ে বর্তমানে আমাদের সামনে যে চিত্রটি সেটি খুবই ভয়াবহ এবং একইসঙ্গে অসহায় অবস্থার। হাসপাতালে শয্যা নেই, আইসিইউ সুবিধা নেই, অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে রোগীর স্বজনদের ছোটাছুটি নিয়মিত ঘটনা। করোনা সংক্রমণের এক বছর পরেও এমন অবস্থার জন্য দায় কাদের?
মোহাম্মদ সহিদুল্লা : এই বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও কষ্টের। আমাদের পরিচিত বা আত্মীয় কেউ যখন অসুস্থতার কথা জানায়, তখন তাদের জন্য চিকিৎসাসেবা কিংবা দরকারি সিটের ব্যবস্থা করতে না পারা খুবই বেদনার হয়ে দেখা দেয়। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যখন হাসপাতালের করোনা সিটের প্রায় ৮০ ভাগ খালি ছিল, তখন আমাদের আলোচনা হচ্ছিল এখন এই সিটগুলো কি নন-কভিড রোগীদের জন্য দিয়ে দেব? সেই পরিস্থিতি থেকে এখন হাসপাতালে শয্যা সংকট। এখন আমরা বললেই হবে না যে, হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়ানো হবে। এটা তো এমন না যে, বললাম আর একটি বিছানা চাদর বিছিয়ে শয্যা বানিয়ে নিলাম। হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। এর সঙ্গে রোগীর সুচিকিৎসার যাবতীয় সক্ষমতাও জড়িত। এরপরেও সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎপরতা ইদানীং চোখে পড়ছে। বলা হচ্ছে, আইসিইউ সংখ্যা বাড়ানো হবে। তবে এত দ্রুত আইসিইউর বাড়ানো বেশ কষ্টসাধ্য। অন্য বিষয়গুলো জরুরি ব্যবস্থায় হয়তো করা সম্ভব। এখন যেটি সবচেয়ে জরুরি, সেটি হচ্ছে নতুন সংক্রমণ রোধ করতে হবে। কেননা, আমাদের রোজ সুস্থ হচ্ছে প্রায় দুই থেকে তিন হাজার। কিন্তু, আক্রান্ত হচ্ছে সাত হাজারের অধিক। তাই এখন সংক্রমণ রোধ এবং হাসপাতালের সেবার পরিসর বৃদ্ধি এই দুটো হাতে হাত ধরে এগিয়ে নিতে হবে। এছাড়া সর্বসাধারণেরও করণীয় আছে। সেটি হলো আক্রান্ত হলেই হাসপাতালে ছুটে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। হাসপাতালের ওপর চাপ তৈরি করা থেকে নিজেদেরও সচেতনভাবে কাজ করতে হবে। করোনা শনাক্ত হলে বাসায় বসেও চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়া যায় এই বিষয়টা মনে রাখতে হবে। তবে যাদের পুরনো ও জটিল রোগ আছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন, এমন রোগীরা অবশ্যই হাসাপাতালে সেবা নিতে যাবে। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে তাদের কাজের গতি বাড়াতে হবে। আমাদের দেশের সক্ষমতা অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে সেবার পরিধি বাড়াতে হবে। যদি সম্ভব হয় আইসিইউ বাড়াতে হবে। যাতে গুরুতর রোগীদের সেবা দিয়ে জীবন রক্ষা করা যায়। এছাড়া করোনার চিকিৎসা হয় এমন কোনো হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স সংকট থাকলে জরুরি ভিত্তিতে যেসব হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা হচ্ছে না, সেখান থেকে ডাক্তার-নার্স এনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দক্ষতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেখাতে হবে।
টিকাদান কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন করতে বেসরকারিভাবে ভ্যাকসিন আমদানি করে টিকাদানের সুপারিশ করেছে পরামর্শক কমিটি। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে বেসরকারিভাবে এই টিকাদান কর্মসূচি চালু হলে তা কতটা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ সহিদুল্লা : বেসরকারিভাবে টিকাদান কর্মসূচি চালু হলে খুবই ফলপ্রসূ হবে। একটু বুঝিয়ে বলি, বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যার অন্তত ১০ কোটিকে টিকা দিতে হবে আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে। এখন এই টিকা সরকার বিনামূল্যে দিচ্ছে। কিন্তু ১০ কোটিকে দেওয়া খুবই কষ্টকর। এটা সরকারের জন্য অসাধ্য। বিশ্বের ধনী দেশগুলোও তা দিতে পারবে না। এখন বেসরকারিভাবে টিকা আনলে দেশের ধনী শ্রেণির লোকেরা নিজেরাই টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারবে, তাদের সেই সক্ষমতা আছে। তখন সরকারের টিকার প্রতি চাপ কমবে। আর সাধারণের জন্য সরকারি ব্যবস্থা তো থাকছেই। বিশ্বে বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে। আমরা বলেছি, এমন ভ্যাকসিন বেসরকারিভাবে আনতে হবে, যেই টিকা সরকার অনুমোদন দেবে। টিকা নিয়ে বিশ্বে ইতিমধ্যে নানামুখী তৎপরতা ও রাজনীতি শুরু হয়েছে। তাই বেসরকারিভাবে টিকা প্রদান করা শুরু হলে সেটি বেশ ফলপ্রসূ হবে বলেই মনে করি।
করোনা পরীক্ষা নিয়েও নানা অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ছে। বিশেষ করে, বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা রিপোর্ট পেতে ভোগান্তি বাড়ছে। প্রবাসী কর্মজীবীরা ছাড়াও দেশে বসবাসকারীরা রয়েছেন। করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে দীর্ঘ সময়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এই দুই শ্রেণির জন্য ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় করোনা পরীক্ষা করা গেলে ভোগান্তি কমত কিনা?
মোহাম্মদ সহিদুল্লা : আমাদের পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে বলা হয়েছে। বিদেশগামী প্রবাসী যারা তাদের বেসরকারিভাবে বা একটু বেশি অর্থ খরচ করে করোনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে। তাই সরকারিভাবে আলাদা জায়গায় করা সম্ভব না হলেও বেসরকারি অনুমোদিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হলে তাদের জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করা গেলে সাধারণ ও প্রবাসী উভয়েরই ভোগান্তি কমবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
2020 topbanglanews24